ইউরোপের পশ্চিমাঞ্চলে গত কয়েকদিন থেকে চলছে তীব্র দাবদাহ। এই অতিউষ্ণ আবহাওয়া ‘হিট অ্যাপোক্যালিপস’-এ রূপ নিতে পারে বলে সতর্ক করেছে ফরাসি কর্তৃপক্ষ। দাবদাহের সঙ্গে দাবানল ক্রমাগত বাড়তে থাকায় ফ্রান্সে এরই মধ্যে অন্তত দেড় হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। যুক্তরাজ্যে বিমানবন্দরের রানওয়ে গলে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ, লোহার রেললাইন গলে যেতে পারে আশঙ্কায় ধীরে চালানো হচ্ছে ট্রেনগুলো। আবহাওয়াবিদরা সতর্ক করেছেন, মঙ্গলবারই (১৯ জুলাই) দেখা যেতে পারে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাসে রেকর্ড সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে জানা যায়, আইবেরিয়ান দ্বীপপুঞ্জের (স্পেন-পর্তুগাল) কিছু এলাকায় তাপমাত্রা বেড়ে ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে, যার ফলে কয়েক ডজন জায়গায় দাবানল শুরু হয়েছে। গত এক সপ্তাহে স্পেন ও পর্তুগালে এক হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন দাবদাহ সম্পর্কিত কারণে। হাসপাতালগুলোতে বেড়েই চলেছে রোগীর চাপ। এমন আবহাওয়ায় বিস্তৃত খরা, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের ভয়ংকর প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে ইউরোপীয় সরকারগুলোকে এই মুহূর্তে আরও একটি গুরুতর চাপ সামলাতে হচ্ছে, তা হলো ক্রমবর্ধমান জ্বালানি সংকট। ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে গোটা ইউরোপেই বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল দেশগুলো, বিশেষ করে জার্মানি।

চলমান দাবদাহের কারণে ইউরোপে এয়ারকন্ডিশনারের (এসি) ব্যবহার বাড়ছে হু হু করে। স্প্যানিশ ইউটিলিটি কোম্পানি এনাগ্যাস গত সপ্তাহে এক বিবৃতিতে বলেছে, দাবদাহে রেকর্ড তাপমাত্রার কারণেই মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
আসন্ন শীতকালের জন্যেও পর্যাপ্ত গ্যাস মজুত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ইউরোপ। তবে মেরামতের কথা বলে এ অঞ্চলের প্রধান পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম ১ দিয়ে আগের চেয়ে কম গ্যাস সরবরাহ করছে রাশিয়া। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ফাতিহ বিরলের ভাষ্যমতে, আগামী কয়েক মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপের স্টোরেজ লেভেল ৯০ শতাংশে পৌঁছানোর আগেই যদি রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ ও চ্যালেঞ্জিং হবে।
জার্মান অর্থনীতি মন্ত্রী রবার্ট হ্যাবেক এক রেডিও সাক্ষাৎকারে বলেন, যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। হতে পারে গ্যাস আবার প্রবাহিত হবে, হয়তো আগের চেয়েও বেশি। আবার এটাও হতে পারে, কিছুই আসবে না।

দ্য গার্ডিয়ানের কলামিস্ট সাইমন টিসডাল লিখেছেন, ইউরোপে বিদ্যুতের ঘাটতি ও বিপর্যয়ে ভরা অশান্তির এক দীর্ঘ, ঠাণ্ডা শীতকাল আসন্ন।
কী করছে ইউরোপ
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ ছাড়াও রুশ জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন ইউরোপীয় নেতারা। তবে এর জন্য নিকট ভবিষ্যতে বড় ঘাটতির মুখে পড়তে হতে পারে তাদের। রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার আশঙ্কা এরই মধ্যে ইউরোপকে সমস্যার পথে ঠেলে দিয়েছে।
ইউরোপের সবচেয়ে প্রভাবশালী সবুজ রাজনীতিবিদদের একজন হ্যাবেক। চাপের মুখে তিনিও এমন পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য দেশগুলোর কার্বন নির্গমন নিরোধক প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তার চেয়ে বড় কথা, এই পথে তিনি একা চলছেন না।

জার্মান সাংবাদিক কনস্ট্যানজে স্টেলজেনমুলার দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে লিখেছেন, জার্মানির বিকল্পগুলো সংখ্যায় কম, অসম্পূর্ণ ও অপ্রীতিকর। হ্যাবেক কয়লা প্ল্যান্টগুলোকে ফের সচল করছেন এবং লোকদের অল্প সময়ে গোসল সারতে বলছেন। তিনি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল নির্মাণের জন্য কেনাকাটা সহজতর ও পরিবেশগত বিধিনিষেধ শিথিল করছেন; পাশাপাশি, ভাসমান টার্মিনাল ভাড়া করছেন। এছাড়া বিকল্প এলএনজি সরবরাহের সন্ধানে কর্তৃত্ববাদী উপসাগরীয় নেতাদের প্ররোচিত করছেন।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে ইউরোপ। তবে সেখানে উল্লেখযোগ্য হারে কার্বন নিঃসরণ বাড়তে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। বহু ইউরোপীয় দেশ কয়লার ব্যবহার বাড়িয়েছে; পাশাপাশি, দীর্ঘমেয়াদী জীবাশ্ম জ্বালানি নিষ্কাশন ও সঞ্চয়স্থানে নতুন বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে।
বার্লিনভিত্তিক পরামর্শক ক্লাইমেট অ্যানালিটিক্সের বিল হেয়ার নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এটি ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তির ইতি টানতে তেল-গ্যাস শিল্পের প্রচেষ্টা বলে মনে হচ্ছে এবং আমি খুবই চিন্তিত যে, তারা এতে সফল হতে পারে।

তবে এর বিপরীতে একটি ভালো দিকও রয়েছে। ইউরোপীয় সরকারগুলো ইইউর সৌরবিদ্যুৎ সক্ষমতা বাড়ানোসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ দ্বিগুণ করছে। থিংকট্যাংক এমবার এবং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বর্তমান ধারা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৬৩ শতাংশ বিদ্যুৎ হবে নবায়নযোগ্য।
এমবারের ইউরোপীয় কর্মসূচির প্রধান চার্লস মুর ব্লুমবার্গকে বলেন, উচ্চহারে কার্বন নিঃসরণের অনুমতি দেওয়া সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এটি যদি বায়ু ও সৌর স্থাপনার ওপর ক্ষুরধার নজরের সঙ্গে মিলিত হয়, তাহলে সম্ভবত অর্থ দাঁড়াবে- দ্রুত জ্বালানি রূপান্তর। আপনার হাতে অন্য বিকল্প থাকলে এটি ঝুঁকিপূর্ণ কৌশল হবে, কিন্তু এখন তা নেই।