বছর পাঁচেক আগেই দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে দিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তার দেখানো পথ ধরে নিজের প্রথম বাজেটেই দেশকে সমৃদ্ধির সোপানে নেওয়ার চেষ্টা করেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। তবে মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে গত দুই বছরে অনেক কিছুই ওলটপালট হয়েছে। করোনার ধকল সামলে ওঠার আগেই সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পুরো বিশ্বে মন্দার পদধ্বনি বাজিয়ে দিয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে নতুন বছরের বাজেট দিতে গিয়ে সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা করতে হয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। এ কারণেই ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকায় প্রত্যাবর্তন’ স্লোগান নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেটে পেশ করেছেন তিনি। সংকট কাটিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ফিরতে অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন খাতে যেমন কর ছাড় দিয়েছেন, তেমনি করের আওতা বাড়িয়ে বেশি সংখ্যক করদাতাকে করজালে আটকানোর চেষ্টা করেছেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন অর্থমন্ত্রী। বিশ্ব অর্থনীতিতে শঙ্কার মধ্যেও কেন এবার বেশি প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা করছেন, সেই ব্যাখ্যাও বাজেট বক্তব্যে তুলে ধরেছেন তিনি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিক চলকসমূহের গতিপ্রকৃতি দেখে প্রতীয়মান হয় যে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ অব্যাহত থাকলেও অর্থনীতির ওপর উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ অর্জিত হবে বলে আশা করা যায়।
পাশাপাশি কোভিড-১৯ মহামারির প্রলম্বিত প্রভাব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখার প্রত্যাশা করেছেন অর্থমন্ত্রী।
বাজেটে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য শিল্পের করপোরেট কর হ্রাস, কাঁচামাল সরবরাহের উৎসে কর হ্রাস, বিদেশে পাঠানো রয়্যালটি, কারিগরি সহায়তা ফি’র উৎসে কর হ্রাস, স্থানীয় শিল্পের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বহাল রাখার পাশাপাশি নতুন শিল্পে অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বিদেশে পাচারের টাকা দেশের অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কর জাল বাড়াতে টিআইএনের (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) রিটার্ন জমা স্লিপ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছানের লক্ষ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ও জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর দিকেও গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এজন্য করপোরেট করহার কমিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগ ও জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর ছক করেছেন তিনি। এজন্য শেয়ারবাজারে অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে এক ব্যক্তির কোম্পানি প্রতিষ্ঠা উৎসাহিত করার জন্য এক ব্যক্তি কোম্পানির করহার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ করা হয়েছে।
পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার আইপিও’র মাধ্যমে হস্তান্তর হলে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার সাড়ে ২২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে আইপিও’র মাধ্যমে ১০ শতাংশের কম শেয়ার হস্তান্তর হলে করহার সাড়ে ২২ শতাংশই রাখা হয়েছে।
এছাড়া তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের করহার আগের মতোই সাড়ে ৩৭ শতাংশ রাখা হয়েছে। অতালিকাভুক্ত ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কারহারেও পরিবর্তন আনা হয়নি। আগের মতো এসব প্রতিষ্ঠানকে ৪০ শতাংশ কর দিতে হবে। মার্চেন্ট ব্যাংকের করহারও অপরিবর্তিত রেখে সাড়ে ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে।
টেক্সটাইল খাতের বিদ্যমান করহার ১৫ শতাংশ চলতি বছরের ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রস্তাবিত বাজেটে এ সুবিধা বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। করদাতারা দীর্ঘমেয়াদে হ্রাসকৃত করহারের এ সুযোগ গ্রহণ করে সঠিকভাবে কর দেবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন অর্থমন্ত্রী।
সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুলসহ সব ধরনের তামাকজাত পণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানির করহার করা হয়েছে ৪৫ শতাংশ ও আড়াই শতাংশ সারচার্জ। এক্ষেত্রেও করহারে পরিবর্তন আনা হয়নি। অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে মোবাইল ফোন কোম্পানির করহার। চলমান অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরের জন্য তালিকাভুক্ত মোবাইল ফোন কোম্পানির করহার ৪০ শতাংশ এবং অতালিকাভুক্ত মোবাইল ফোন কোম্পানির করহার ৪৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
তবে ব্যক্তি সংঘের করহার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করা হয়েছে। কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা ও অন্যান্য করযোগ্য সত্তার করহারও ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করা হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা কেবলমাত্র তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজের করহার চলমান অর্থবছরের মতো ১৫ শতাংশ রাখা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে বলেন, অর্থনীতিতে নগদ লেনদেনের প্রাধান্য রাজস্ব আহরণের অন্যতম অন্তরায়। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে নগদ লেনদেন হ্রাস করা গেলে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির সঙ্গে সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাসহ সমতাভিত্তিক এবং কল্যাণমূখী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। এ বিষয় বিবেচনায় রেখে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারের লক্ষ্যে ২০২১ সালের অর্থ আইনে করপোরেট করহার সাড়ে ৩২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে করপোরেট করহার আরও কমানোর প্রস্তাব করছি। এক্ষেত্রে সব ধরনের প্রাপ্তি ও আয় অবশ্যই ব্যাংক স্থানান্তরের মাধ্যমে গৃহীত হতে হবে এবং ১২ লাখ টাকার অতিরিক্ত ব্যয় ও বিনিয়োগ অবশ্যই ব্যাংক স্থানান্তরের মাধ্যমে সম্পাদন করতে হবে।
ব্যবসা সহজীকরণ ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে ট্রেডিং পণ্য সরবরাহের ওপর উৎসে করহার ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি সরবরাহ ছাড়া বই সরবরাহের ওপর উৎসে করহার ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে উৎপাদনকারীর কাছে কাঁচামাল সরবরাহের ওপর উৎসে করহার ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে।
উৎসে কর আদায় কার্যক্রম গতিশীল করতে কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। চাইলে কর কর্মকর্তারা ব্যবসা প্রাঙ্গণে বাধাহীনভাবে প্রবেশ করতে পারবেন। পাশাপাশি অ্যাকাউন্ট বই ও রেকর্ড বই জব্দ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে কর কর্মকর্তা বাধার শিকার হলে উৎসে কর্তনকারী প্রতিষ্ঠান বা বাধা প্রদানকারী ব্যক্তিকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবেন।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর ছাড় দেওয়া হলেও করনেট সম্প্রসারণের লক্ষ্যে হোটেল, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার এবং ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিকে উৎসে কর কর্তনকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যের উৎসে কর দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে হাঁস, মুরগির খামার এবং সব ধরনের হ্যাচারি ও মাছ চাষ থেকে আয়ের ওপর অভিন্ন করহার আরোপ করা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেট দিতে গিয়ে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার পূর্বাভাসের বিষয়টি মাথায় রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। এজন্য বিদেশে অর্জিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে তার ওপর ১৫ শতাংশ, বিদেশে থাকা অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে তার ওপর ১০ শতাংশ এবং বাংলাদেশে রেমিটকৃত নগদ অর্থের ওপর ৭ শতাংশ হারে কর ধার্য করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
ফলে অর্থনীতির মূল স্রোতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে, আয়কর রাজস্ব আহরণ বাড়বে এবং করদাতারা বিদেশে তাদের অর্জিত অর্থ-সম্পদ আয়কর রিটার্নে প্রদর্শনের সুযোগ পেয়ে স্বস্তিবোধ করবেন বলে আশা অর্থমন্ত্রী।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অর্থনীতির মূলধারায় অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে এবারের বাজেটেও বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠান তার মোট কর্মচারীর ১০ শতাংশ বা ২৫ জনের বেশি প্রতিবন্ধী বা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের নিয়োগ দিলে ওই কর্মচারীদের পরিশোধিত বেতনের ৭৫ শতাংশ বা প্রদেয় করের ৫ শতাংশ যেটি কম তা নিয়োগকারীকে কর রেয়াত হিসেবে দেওয়া হবে।
পণ্য ও সেবা রপ্তানি উৎসাহিত করার জন্য গার্মেন্টসের মতো অন্যান্য পণ্য ও সেবা রপ্তানি খাতের করহার ১২ শতাংশ করা হয়েছে। গ্রিন শিল্পের করহার ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ দিয়ে বহির্বিশ্বে সেবা প্রদানের বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যাংকিং চ্যানেলে আনা আয়কে ২০৩০ সাল পর্যন্ত করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নকে বহুমাত্রিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে স্টার্ট-আপ উদ্যোগকে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। স্টার্ট-আপ উদ্যোক্তাদের আয়কর রিটার্ন দাখিল বাদে অন্যান্য সব ধরনের রিপোর্টিংয়ের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। সেই সঙ্গে স্টার্ট-আপ কোম্পানির লোকসান ৯ বছর পর্যন্ত সমন্বয়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্টার্ট-আপ উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে ব্যয় সংক্রান্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার ও টার্নওভার করহার দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন সহজ ও মূল্য সাশ্রয়ী করার লক্ষ্যে গ্যালভানাইজড আয়রন শিট বা স্টিলজাত পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত এইচ আর কয়েল এবং জিংক অ্যালয়জাতীয় কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে করহার ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। দেশে বৈধপথে স্বর্ণ আমদানি উৎসাহিত করা এবং স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধ করার লক্ষ্যে স্বর্ণ আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান অগ্রিম কর বিলোপ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এদিকে রাজস্ব আয় বাড়াতে সুদ আয়ের ওপর উৎসে কর বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের সুদ আয়ের ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর কাটা হয়। এটি বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। পাশাপাশি রিটার্ন জমার স্লিপ না দিলে অতিরিক্ত আরও ৫০ শতাংশ উৎসে কর কাটা হবে। স্বীকৃত প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ফান্ড, সুপার অ্যানুয়েশন ফান্ড ও পেনশন ফান্ডের অর্থ ব্যাংকে জমা রাখতে তার সুদ আয়ের ওপর ৫ শতাংশ উৎসে কর কাটা হবে। তবে ব্যক্তি করদাতাদের সুদ আয়ের ওপর উৎসে কর আগের মতো ১০ শতাংশ রাখা হয়েছে।
করের আওতা সম্প্রসারণে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য আগামী ১ জুলাই থেকে ব্যবসা কেন্দ্র বা দোকানে টিআইএনের (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) পরিবর্তে রিটার্ন জমার স্লিপ ঝোলানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ব্যত্যয় ঘটলে সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে।
সেই সঙ্গে যেসব এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ভার্সন চালু রয়েছে তাদের আয়কার রিটার্ন দাখিলের বিধান করা হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে তিন বছর বা ততোধিক সময়ব্যাপী কোনো কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ থাকলে পরিচালকদের কাছ থেকে বকেয়া অবিতর্কিত কর আদায়ের বিধান করা হয়েছে। এছাড়া সরকারের অবিতর্কিত রাজস্ব দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হলে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ অন্যান্য সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে।
বিশ্বায়নভিত্তিক অর্থনীতির যুগে রাজস্ব আদায়ে অনিবাসী করদাতা এবং ডিজিটাল সার্ভিস থেকে যথাযথ কর সংগ্রহ এবং আইন পরিপালনে বাধ্যবাধকতা আরোপ রাজস্ব আদায়ে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থমন্ত্রী। তাই এ খাত থেকে সঠিক রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশে অনিবাসীর স্থায়ী স্থাপনা না থাকলে রিটার্ন দালিখ না করার বিধান বিলোপের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সেই সঙ্গে অনিবাসী থেকে কর সংগ্রহের লক্ষ্যে রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক অনিবাসীর আয়ের আওতা, অব্যাহতি ও ক্ষেত্র নির্ধারণে যুযোপযোগী বিধি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ডিজিটাল উপস্থিতির মাধ্যমে বাংলাদেশে আয় উপার্জনের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ উপস্থাপনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
রাজস্বনীতি সংস্কারের মাধ্যমে সরকারের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনা এবং বেসরকারি খাতের করহার যৌক্তিকীকরণ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে উন্নতি সুসংহত করবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। এজন্য আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে খেলাপি ঋণের ওপর করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ মওকুফ করলে তা করমুক্ত রাখা হয়েছে। বাজেটে ব্যক্তি করদাতা ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক করদাতাদের খেলাপি ঋণ মওকুফ করা হলে তা করযোগ্য আয় হিসাবে গণ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
রাজস্ব আয় বাড়াতে অর্থমন্ত্রী শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত-তাপানুকুল সার্ভিসের পাশাপাশি প্রথম শ্রেণির রেলওয়ে সেবার ওপর ১৫ শতাংশ মূসক আরোপের প্রস্তাব করেছেন। সেই সঙ্গে বিদেশ থেকে পাখি আনার ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আমদানি করা সোলার প্যানেলের ওপর বিদ্যমান আমদানি শুল্ক শূন্য শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বিলাসবহুল গাড়ি থেকেও রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। এজন্য ৪০০০ সিসির ওপর বিলাসবহুল রিকন্ডিশন গাড়িতে সম্পূরক শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ও আগাম কর এবং ভ্যাট মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৮০০ শতাংশ করহার প্রস্তাব করা হয়েছে। রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে অব্যাহতি প্রত্যাহার করে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। অবশ্য ফ্রিজ তৈরির উপকরণ ও যন্ত্রাংশ আমদানি এবং স্থানীয় ক্রয়ের ক্ষেত্রে কর ছাড় সুবিধা রয়েছে। ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
বাটার ও চিজ বা পনির পণ্য দুটি সমজাতীয় উল্লেখ করে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বাটার আমদানিতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বিদ্যমান থাকলেও চিজ আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক আরোপিত নেই। তাই বাটারের মতো চিজ আমদানিতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রীর নজর থেকে বাদ যায়নি গ্যাস লাইটারও। বর্তমানে দেশে গ্যাস লাইটার বা দেশলাই উৎপাদিত হচ্ছে। তাই দেশীয় শিল্পের সুরক্ষার জন্য পণ্যটি আমদানির ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই বিবেচনায় লাইটারের যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
মোবাইল ফোনের ব্যবসায়ী পর্যায়ে বিদ্যমান ৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহতি প্রত্যাহার এবং বিদেশি চার্জারের আমদানিতে শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রক্রিয়াজাত ও রেডি টু কনজিউম কফি আমদানিতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য ব্যবহার করা ওয়াটার পিউরিফায়ারের আমদানি শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। ক্যাশ রেজিস্টার আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্কজুড়ে দেওয়া হয়েছে। ল্যাপটপ, কম্পিউটার আমদানিতে মূসক অব্যাহতি তুলে দিয়ে ১৫ শতাংশ মূসক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিড়ি-সিগারেটের শুল্ক বাড়ানোর কারণে ধূমপায়ীদের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হবে।
বাজেট ঘাটতি
বাজেটের আকার যেমন বড়, তেমনি এ বাজেটে ঘাটতিও ধরা হয়েছে বড়। অনুদান বাদে এই বাজেটের ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশের সমান। অনুদানসহ বাজেট ঘাটতির পরিমাণ হবে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৪০ শতাংশের সমান।
এ ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা, যার মধ্য থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা বৈদেশি ঋণ পরিশোধ করা হবে। ফলে প্রকৃত বৈদেশিক ঋণ দাঁড়াবে ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে যে ঋণ নেওয়া হবে তার মধ্যে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকায় নেওয়া হবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৬৮ হাজার ১৯২ কোটি টাকা এবং স্বল্প মেয়াদি ঋণ ৩৮ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ ধরা হয়েছে ৪০ হাজার ১ কোটি টাকা। যার মধ্যে জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্প থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা এবং ৫ হাজার ১ কোট টাকা অন্যান্য খাত থেকে নেয়া হবে।
ব্যয়
নতুন অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ১১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে আবর্তক ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৩ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৭৩ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। মূলধনী ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৮ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। খাদ্য হিসেবে ৫৪০ কোটি টাকা এবং ঋণ ও অগ্রিম ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৫০১ কোটি টাকা।
অন্যদিকে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। এডিপিবহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। এছাড়া বিভিন্ন স্কিম বাবদ ৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির জন্য ২ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
আয়
ব্যয়ের বিপরীতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক অনুদান ৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। রাজস্বের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তার মধ্যে কর ৩ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত কর ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডবহির্ভূত কর ১৮ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত আয় ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
কোথায় কত বরাদ্দ
প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের ১৪ দশমিক ৭০ শতাংশ থাকছে এ খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে সুদের জন্য। এ খাতে বরাদ্দ ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ। ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে। ভর্তুকি ও প্রণোদনায় থাকছে ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ।
এছাড়া জনপ্রশাসনে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ, স্বাস্থ্যে ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ, প্রতিরক্ষায় ৫ শতাংশ, জ্বালানি ও বিদ্যুতে ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ, কৃষিতে ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণে ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় ৪ দশমিক ৪০ শতাংশ, গৃহায়ণে ১ শতাংশ, বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্মে দশমিক ৮০ শতাংশ, শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিসে দশমিক ৬০ শতাংশ, পেনশনে ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং বিবিধ ব্যয়ের জন্য ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।