
ঢাকার ধানমন্ডির ঐতিহ্যবাহী গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে বেপরোয়া লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) এ বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। অভিযোগের একটি কপি জাগো নিউজের হাতে এসেছে।
সেখানে দাবি করা হয়েছে, স্কুলের তহবিলের অর্থ দিয়ে ফ্ল্যাট কেনা, ব্যক্তিগত গাড়ি চালকের বেতন নির্বাহ, ভুয়া ভাউচারে অর্থ আত্মসাতের মতো ঘটনাও ঘটছে। এসব অর্থ সংস্থানে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে অনৈতিক ফি। মডেল টেস্ট, ক্রীড়া, মিলাদ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ নানান খাতে বেপরোয়া হারে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নাজেহাল ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলেও দাবি করা হয়েছে।
তবে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভুঁইয়া সব অভিযোগ নাকচ করে দেন। তিনি জাগো নিউজের কাছে দাবি করেন, উত্থাপিত অভিযোগ সবই অসত্য। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এমনকি এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হলে মামলা করারও হুমকি দেন আবু সাঈদ ভুঁইয়া।
মাউশিতে জমা দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও তাকে বদলি করা হচ্ছে না। সাত বছর ধরে তিনি ঐতিহ্যবাহী স্কুলটি ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। স্কুলের ফান্ড থেকে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত অর্থ আত্মসাৎ করছেন।
২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে মডেল টেস্টের নামে প্রতিজনের কাছ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা হারে ৪ লাখ টাকা আদায় করেছেন। অথচ সেখানে সর্বোচ্চ ৩৭ জন পরীক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। এ অর্থ তিনি নিজে আত্মসাৎ করেছেন। প্রতিষ্ঠানের ফান্ডের প্রায় দুই কোটি টাকার মধ্যে এক কোটি ৩৫ টাকা দিয়ে ধানমন্ডিতে একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন স্থানে তার নিজস্ব প্লট-ফ্ল্যাট রয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে গত দুই বছর স্কুল বন্ধ থাকলেও বিভিন্ন ভাউচারে ১০ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন। এমনকি প্রধান শিক্ষকের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পাড়িচালককে স্কুলের ফান্ড থেকে মাসিক বেতন ও অন্যান্য সুবিধা দিয়ে আসছেন। বিভিন্ন সময় স্কুলে নবীনবরণ, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণের নামে প্রায় ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভুঁইয়া-ছবি সংগৃহীত
লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, বিভিন্ন কূটকৌশলের মাধ্যমে গভর্নমেন্ট হাই স্কুলের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে একজন দুর্নীতিবাজ শিক্ষক সাত বছর ধরে আঁকড়ে আছেন। এমন শিক্ষক কারও কাছে কাম্য নয়। স্কুলটি রক্ষা করতে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষককে বিচারের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে অভিভাবক, ছাত্র, শিক্ষকের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়েছে।
মাউশি থেকে জানা যায়, সারাদেশে প্রায় সাড়ে ৪০০ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং স্কুল অ্যান্ড কলেজ রয়েছে। সরকারি মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজে পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয় না। প্রতিটি জেলার আঞ্চলিক উপ-পরিচালকের মাধ্যমে নিয়মিত পরিদর্শনের কথা থাকলেও সেদিকে তাদের নজর থাকে না। শুধু এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তিতে একটি কমিটি রয়েছে। তারা ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করে। সে কারণে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্যে জড়িয়ে পড়ছেন। প্রতিনিয়ত ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার প্রধানদের বিরুদ্ধে আর্থিকসহ নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ আসছে। গত তিন মাসে এ ধরনের ১০টি অভিযোগ এসেছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভুঁইয়া বলেন, একটি মহল আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে কয়েকজন শিক্ষক রয়েছেন। বিভিন্ন অনিয়ম করায় তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় তারা আমার বিরুদ্ধে এসব কাজ করছেন।
গত তিন মাসের এ ধরনের ১০টি অভিযোগ এসেছে মাউশিতে-ফাইল ছবি
জানতে চাইলে মাউশির পরিচালক (বিদ্যালয়) অধ্যাপক বেলাল হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, সম্প্রতি গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে খতিয়ে দেখবো। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেমের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যালয়ে অনিয়ম নির্দিষ্ট করে খাত ও সময় উল্লেখ করে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। এটি শুধু প্রধান শিক্ষক একা নন, তার একাধিক দোসর জড়িত রয়েছেন। সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেহেতু ম্যানেজিং কমিটি নেই বলে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা সর্বময় ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। তাদের মনিটরিংয়ের জন্য আঞ্চলিক উপ-পরিচালকদের দায়িত্ব দেওয়া হলেও তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না বলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এসব মাঠ কর্মকর্তাকেও জবাবদিহিতার আনতে আহ্বান জানান তিনি।