আফগানিস্তানে তালেবানদের স্বেচ্ছাচারিতা ও ভয়াবহতার প্রকৃতরূপ তুলে ধরতে জীবনবাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছেন গণমাধ্যম কর্মীরা। আর এ কারণেই দেশটিতে বারবার তালেবান বর্বরতার টার্গেটে পরিণত হচ্ছে সাংবাদিক গোষ্ঠী।
আফগানিস্তানে তালেবানদের শাসনে লুণ্ঠিত হচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। সরকারের পছন্দের বিরুদ্ধে খবর করলেই নেমে আসছে অমানবিক অত্যাচার। বিনা বিচারে আটকে রাখা হচ্ছে সাংবাদিকদের। ভয়ঙ্কর মারধর করা হচ্ছে। স্বাধীন মত প্রকাশের বিন্দুমাত্র সুবিধা নেই। সাংবাদিকদের ওপর অত্যাচারের বহর দিন দিন বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে ছবি সমেত উঠে আসছে তালেবান হামলার ভয়ঙ্কর খবর। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তালেবান বর্বরতার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়া জানালেও বিন্দুমাত্র কমছে না অত্যাচারের মাত্রা। ফলে বহু গণমাধ্যম বন্ধ হচ্ছে। বেকার হচ্ছে তাদের কর্মীরা।
অতি সম্প্রতি তালেবান বর্বরতার শিকার হলেন আফগান টেলিভিশনের ঘোষক মহেব জলিলী। ১৬ এপ্রিল রাত ৮টা নাগাদ কাবুল শহর থেকে তাকে অপহরণ করা হয়। হাত-ই-সুভ গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাতকারে জলিলী বলেছেন, কী কারণে গ্রেফতার হতে হয়েছে সেটাও তালেবান সরকার তাকে জানায়নি। বন্দি অবস্থায় অকথ্য পন্থায় অত্যাচার করা হলেও নিজের অপরাধ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। সরকার জলিলীর বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে।
স্থানীয় সাংবাদিক শরীফ হাসানিয়ারের অভিযোগ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকায় প্রতিনিয়ত ভুগতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। তিনি জানান, তাঁর সহকর্মী জলিনীকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। সামাজিক গণমাধ্যমে তিনি লেখেন, 'রাতের অন্ধকারে আমার প্রাক্তন সহকর্মী জলিনীকে আফগান গোয়েন্দারা তুলে নিয়ে যায়। তারপর বর্বরোচিত হামলা চালায় জলিনীর ওপর। তালেবানদের বেধড়ক মারধরে সে এখন গুরুতর জখম।'
রাসা টিভি-র ম্যানেজার জামশী আহমাদ আহমদী কাবুল শহরেই গুলিবিদ্ধ হন। তালেবানরাই তাকে জখম করেছে বলে অনেকেরই সন্দেহ। গুলিবিদ্ধ জামশী এখন কোথায় আছেন বা কেমন আছেন, সেটাও জানা যাচ্ছেনা।
তালেবানরা ফের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই দুর্ভোগে রয়েছেন আফগান সাংবাদিকরা। বিশেষত যারা বিদেশী গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা রয়েছেন, তারা রয়েছেন সবচাইতে বড় ঝুঁকিতে। এমন এক নিরাপত্তাহীন অবস্থা যেখানে কোন সাংবাদিক নিহত হলে তার কোন দায় দেশটির তালেবান সরকারের নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চলছে খুন, গুমসহ বিবিধ অত্যাচার।
২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালেবানরা কাবুল দখলের পর থেকেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নারীদের অর্জিত মৌলিক অধিকারের মতোই লুণ্ঠিত হয়। ২০০১ সাল থেকে লিঙ্গ সমতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখতে যেসব প্রয়াস শুরু হয়েছিল সেগুলির আর কোনও অস্তিত্ব নেই। তালেবান শাসনে হিংসাই একমাত্র প্রাপ্তি নাগরিকদের।
গান-বাজনা নিষিদ্ধ ঘোষণার পর ২৮ মার্চ তালেবান জেনারেল ডিরেক্টরেট অফ ইন্টেলিজেন্স অন্তত চারটি রেডিও স্টেশনে তল্লাশির নামে হুজ্জুতি চালায়। ৬ জন গণমাধ্যম কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয় এ সময়। একই দিনে বিবিসি ও ডিডব্লিউ-সহ জনপ্রিয় অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকেও আফগানিস্তানে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তালেবান সরকার। পরের দিনই ডিডব্লিউ ও বিবিসি সংবাদ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান আফগানিস্তানে বন্ধ করার কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
পাশাপাশি, সরকারি কর্মকাণ্ডের প্রচারণার জন্য তালেবান সরকারের আধিকারিকরা নিয়মিত গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেন। প্রতিনিয়ত সাংবাদিকদের সরকারি বিধিনিষেধ সম্পর্কে অবগত করার নামে তাদের অধিকার খর্ব করা হয়। সাংবাদিকরা অনেকেই অভিযোগ করছেন, বৈঠকে ডেকে নিয়ে তাদের হয়রানি ও মারধর করা হয়। কোনও অভিযোগ ছাড়াই বন্দি করে রাখা হয় সাংবাদিকদের।
আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় টেলিভিশন টলো নিউজ-এর অন্তত তিন জন কর্মীকে ১৭ মার্চ উঠিয়ে নিয়ে যায় গোয়েন্দারা। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিষেধাজ্ঞা অবজ্ঞা করে বিদেশী নাটক সম্প্রচারের।
সংবাদ পাঠক বাহরাম আমান তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, 'প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর আমাকে জেলখানা থেকে ছাড়া হয়েছে। চিরকাল আমি মানুষের কথা বলে যাব।'
আলজাজিরা-র খবর, বাহরামকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি তালেবান সিক্রেট সার্ভিস সকলকে বিবৃতি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে 'ইসলামের মূলনীতি' লঙ্ঘন করা চলবেনা। সেইসঙ্গে তালেবানদের বিরুদ্ধে আফগান নাগরিকদের মগজধোলাইও বরদাস্ত করা হবেনা।
সিক্রেট সার্ভিসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'কোনও কোনও গণমাধ্যম ইসলামধর্মীদের 'ধর্মীয় অনুভূতি' এবং জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকারক খবর সম্প্রচার করছে। মন্দ এবং দুষ্ট লোকেরা এইসব গণমাধ্যম থেকে দেশবিরোধী কাজের রসদ পাচ্ছে।'
আফগানিস্তানে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা লুণ্ঠিত হওয়ায় উদ্বেগে আন্তর্জাতিক মহলও। জাতিসংঘ এবং কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) সাংবাদিকদের গ্রেফতার ও হয়রানির নিন্দা করেছে। সেইসঙ্গে তারা দাবি করেছে, তালেবান সরকারকে অবিলম্বে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার, হয়রানি, মারধর করা বন্ধ করতে হবে। সেইসঙ্গে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আল জাজিরা জানিয়েছে, সিপিজে তাদের বিবৃতিতে বলেছে, 'তালেবানকে অবিলম্বে... আফগানিস্তানের গণমাধ্যম কর্মীদের আটক ও ভয় দেখানো বন্ধ করতে হবে'। আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহায়তা মিশন (ইউএনএএমএ)-ও সাংবাদিকদের কথায় কথায় বন্দি করা বা তাদের কাজের স্বাধীনতা হরণ করে বিধিনিষেধের বহর বাড়ানোর তীব্র বিরোধিতা করেছে। ইউএনএএমএ টুইটারে লিখেছে, 'তালেবানদের হুমকি প্রদান এবং নিষিদ্ধ ঘোষণা বন্ধ করার সময় হয়েছে। সময় হয়েছে আফগানিস্তানের গণমাধ্যমের সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনা শুরু করার।'
কুনার অঞ্চলের এক সাংবাদিকের বরাত দিয়ে জার্মান সংবাদ সংস্থা ডিডাব্লিউ জানায়, সশস্ত্র তালেবান সেই সাংবাদিকের বাড়িতে গিয়েছিল। তিনি তখন ঘরে ছিলেন না। তার বাবাকে বলে আসা হয়, ছেলে এলে যেন খবর দেওয়া হয়। তার সঙ্গে জরুরি দরকার আছে। তার পর থেকে ওই সাংবাদিক গা ঢাকা দিয়ে আছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, জেহাদ-বিরোধী প্রোপাগান্ডা করেছেন তিনি। কিছুদিন বিদেশি সংবাদসংস্থার সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। এটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখে এমন সাংবাদিকদের খুঁজে বের করছে তালেবানরা।
দেশটিতে নারী সাংবাদিকদের অবস্থা আরো ভয়াবহ। তালেবান জানিয়ে দিয়েছে, ক্যামেরার সামনে নারীরা আসতে পারবেন না। রেডিও-তে কথা বলতে পারেন। তবে সেই অফিসে সকলকে নারী হতে হবে! এক নারী সাংবাদিকের মুখের ভাষা শুনলেই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, 'বহু সংবাদসংস্থার অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। নারীরাও কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। তিনি যে রেডিও-তে কাজ করেন, সেখানে টেকনিশিয়ানরা পুরুষ। ফলে তিনি অফিসে যেতে পারছেন না।'
দেশটিতে কাবুলের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানেও সাংবাদিকদের রাস্তায় ফেলে পেটানো হয়েছে, সংবাদ 'পছন্দ না হওয়ায়' তালেবানরা কাজটি করেছেন। ২০২১ সালে কাবুলে দুইজনকে এভাবে মারাও হয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দেয়া এক বিবৃতিতে হোম অব ফ্রিডম অফ স্পিচ দাবি করে, তালেবানদের ক্ষমতা দখলের পর মিডিয়া, আফগান সাংবাদিক, বাক স্বাধীনতা এবং মিডিয়ার স্বাধীনতার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের মিডিয়া এবং সাংবাদিকরা তাদের স্বাধীনতা হারিয়েছে এবং তারা কাবুল কর্তৃপক্ষ দ্বারা পদ্ধতিগতভাবে দমনের শিকার হচ্ছে। আফগানিস্তানের ইসলামিক আমিরাতের (আইইএ) গোয়েন্দারা আফগান মিডিয়া এবং সাংবাদিকের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে এবং তারা চাচ্ছে মিডিয়া তাদের প্রোপ্যাগান্ডা প্লাটফর্মে পরিণত হোক। গোয়েন্দারা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে তা করতে সফল হয়েছে কারণ তারা হুমকি, বল এবং চাপ হিসাবে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করছে।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার এবং আফগান ইন্ডিপেনডেন্ট জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর সেখানকার ৫৪৩টি গণমাধ্যমের মধ্যে ২৩১টিই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ৬ হাজার ৪০০-রও বেশি সাংবাদিক হারিয়েছেন তাদের কর্মসংস্থান। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়েছে দুটি কারণে। প্রথমটি হলো মারাত্মক আর্থিক সঙ্কট। এবং দ্বিতীয়টি, সাংবাদিকরা অনেকেই তালেবানদের অত্যাচারে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। চলতি বছরেও বহু গণমাধ্যম বন্ধ হয়েছে। তালেবানরা তাদের অমানবিক বর্বরতার বিষয়ে দুনিয়ার মানুষকে অন্ধকারে রাখতে ধনে-প্রাণে শেষ করে দিতে চাইছে সংবাদমাধ্যমকে। তাই দিন দিন বাড়ছে অত্যাচারের বহর।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।